একটা দেশ দেউলিয়া হয়ে গেলে কি পরিনতি হয়?
অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসে যে একটা দেশ যখন দেউলিয়া হয়ে যায় তখন কি ঘটে দেশটির ভাগ্যে?
২০১২ সালে আর্জেন্টিনার নৌবাহিনীর জাহাজ লিবারটাড সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েটস সহ মোট ২৫০ জন ক্রু নিয়ে বার্ষিক প্রশিক্ষণ মহড়ায় ছিল। দেশটির বৈদেশিক ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হবার কারনে এলিয়ট ক্যাপিটাল ঘানার টেমা বন্দরে ক্রু সমেত জাহাজটি বেশ কয়েকমাস আটকে রাখতে সমর্থ হয়। যদিও পরে জাহাজটি ছেড়ে দেয়া হয় তবে এটি একটি দেশের জন্য চরম লজ্জার।
ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হবার রেকর্ড গ্রিসের। তাদের ইতিহাসে অসংখ্যবার তারা দেউলিয়া হয়েছে। গ্রিসের দেউলিয়া হবার ইতিহাস অনেক পুরানো। ৩৭৭ খ্রিষ্টপূর্বে গ্রিস বিশ্বের প্রথম দেউলিয়া হয়। ১৮২৯ সালে স্বাধীনতার পর থেকে তারা অসংখ্যবার দেউলিয়া হয়েছে।
স্পেন আঠারো ও উনিশ শতকে প্রায় ১৫ বার দেউলিয়া হয়েছে।
যখন কোন দেশের ঋন ব্যাবস্থাপনা সঠিক পথে থাকেনা তখন দেশের ফিসকাল প্রেসার বাড়তে থাকে। শুরু হয় আইএমএফ এর সাথে যোগাযোগ। দেউলিয়া হবার থেকে বাঁচাতে আইএমএফ বেইল আউট প্যাকেজ (জামিন) অফার করে। ১৯৫০ সালে আইএমএফ এর সদস্য হবার পর থেকে পাকিস্তান ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ২২ বার বেইল আউট প্যাকেজ নিয়েছে। দেউলিয়া হবার থেকে বাঁচতে আইএমএফ যে প্যাকেজের শর্তে ডলারে ঋন দেয়, সেটা খুব বেশি সহজ শর্তে দেয়া হয়না। এর জন্য আইএমএফ তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করে দেশকে। তবে তার জন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেটে বিভিন্ন খাতে খরচ কমানো, ভর্তুকি বন্ধ করা, ব্যাবসার পলিসি পরিবর্তন সহ নানা রকমের শর্ত মেনে নিতে রাজি হতে হয়।
দেউলিয়া নিয়ে বহু দেশের অভিজ্ঞতা ভয়ানক। ১৮৮২ সালে মিশরের দেউলিয়া হবার জন্য যুক্তরাজ্য মিশর আক্রমন করে। ১৯১৫ সালে আমেরিকা হাইতি দখল করে নেয়। ১৮৯০ এর দশকে আমেরিকা ভেনিজুয়েলাকে হুমকি দিতে তাদের নৌশক্তির হুমকি দেয় যেটা পরবর্তীতে গানবোট ডিপ্লোমেসি নামে পরিচিতি পায়।
অতিতের এসব উন্মাদনা এখন একেবারেই নেই সেটা বলা যাবে না। তবে ধরনে বেশ পরিবর্তন এসেছে।
এবার আসা যাক দেউলিয়া শব্দ নিয়ে। একজন ব্যাক্তি যখন আদালতের মাধ্যমে দেউলিয়া ঘোষিত হয় তখন তার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি আদালতের নির্দেশ সাপেক্ষে বিক্রি করে যতটুকু সম্ভব দেনা শোধ করা হয়। চলার মত অল্প কিছু সম্পদ সে রাখতে পারে। তবে একেক দেশে আইন অনুযায়ী সেটা নির্ধারিত হয়। অনেক দেশে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যাক্তি ভোটাধিকার সহ রাষ্ট্রের অনেক সুবিধা হারান।
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক একটা দেশ দেউলিয়া হলে তখন কি হবে?
সত্যিকার অর্থে একটি দেশ কখনো দেউলিয়া হয়না। যখন কোন দেশের সরকার ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হয় তখন সেই দেশের সরকার দেউলিয়া হয়। আগে ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হলে এক দেশ আরেক দেশকে আক্রমন করার হুমকি দিত বা আক্রমন করত। কিন্ত ইউএন চার্টার আর্টিকেল ২ (৪) অনুযায়ী, ঋন পরিশোধে ব্যার্থ দেশের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তার মানে এই নয় যে, এতে একটি দেশ নিজেদের দেউলিয়া ঘোষনা দিয়ে বেঁচে গেল। এরকম ক্ষেত্রে দেশটির সব ঋন বা আংশিক ঋন পুন:তফসিল করা হয়। বিদেশি ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হলে একটি দেশের সরকারকে চরম চাপে থাকতে হয়।
শুরুতেই দেউলিয়া ঘোষিত দেশের মুদ্রার মান দ্রুত পড়তে থাকে। নিজেদের কারেন্সির মানের উপর নিয়ন্ত্রন থাকেনা। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অনেকেই যুক্তি দেখান জাপানের ইয়েনের বাজার দর তো অনেক কম, শ্রীলংকা বা পাকিস্তানি মুদ্রার মান কমালে তাহলে সমস্যাটি কোথায়? সমস্যা হল ইয়েন স্টাবল কারেন্সি। একটি দেশ চাইলে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে কারেন্সির মান কমাতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেদেশের মুদ্রার মানের উপর নিয়ন্ত্রন থাকে দেশটির অথবা মুদ্রার মানের হরহামেশা বড় রকমের দরপতন হয়না। এক্ষেত্রে চীন উদাহরন হতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলির অভিযোগ চীন মুদ্রার মানের সুবিধা নেয়ার জন্য ইউয়ান এর মান কমিয়ে রেখেছে।
ঋন পরিশোধে ব্যার্থ হওয়া বা ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলির ক্ষেত্রে মুদ্রার দরপতনকে বলা যায় ফ্রি ফল। শ্রীলংকা এক্ষেত্রে ভাল উদাহরন হতে পারে। মার্চের শুরুর দিকে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাবধানে শ্রীলংকার কারেন্সি ডলারের বিপরীতে ৫৭ রুপি হারায়। এপ্রিলের ১২ তারিখে এসে এক মাসের ব্যাবধানে সেটি ৩২৫.০৪ লঙ্কান রুপিতে ঠেকেছে।
এরকম ক্ষেত্রে একটা দেশের সবথেকে বড় যে ক্ষতি হতে পারে সেটা হল ক্রেডিট এক্সেস বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঝুঁকি যেখানে বেশি সেখানে কেউ ঋন দিতে চায়না। দিলেও তার শর্ত ও ইন্টারেস্ট রেট থাকে অনেক বেশি। এরকম ক্ষেত্রে আমদানি বিল পরিশোধের মত অর্থ থাকেনা দেশের। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেকোন দেশ বৈদেশিক বাণিজ্য না করতে পারলে ভয়াবহ পরিনতির শিকার হতে হয়। দ্রব্যমূল্যের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। শুরু হতে পারে সিভিল আনরেস্ট। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার দরুন দেশটির পোশাক খাতে ঈর্ষা করার মত সাফল্য মুহুর্তে ফিকে হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ এর অভাবে কারখানা বন্ধ। রপ্তানির জন্য যে কাঁচামাল আমদানি করতে হবে সেটির পথ প্রায় রুদ্ধ।
দেশে চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসলে সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষনে বোঝা যায়, ডলার বাড়াতে মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রন চেষ্টা করে সরকার। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকে বা এটিএম বুথে টাকা তুলবার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সর্বশেষ গ্রিস এরকম পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রায় ২০ দিন ব্যাংকিং বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
আরেকটা দীর্ঘমেয়াদী বাজে প্রভাব পড়ে দেশটির সভরেইন রেটিং এ। S&P বা Moody's এর মত প্রতিষ্ঠানে দেশটি নন ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডে নেমে যায়। আউটলুক নেগেটিভ হয়ে যায়। এর ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যায়। সর্বোপরি দেশের সব সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বিশাল মার্জিনে কমে যায়। মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি এমন ও হতে পারে যে জিম্বাবুয়ের মত ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যাংক নোট ইস্যু করেও রক্ষা হয়না। অনেকক্ষেত্রে অন্য দেশে সঞ্চিত একটি দেশের সম্পত্তিও হাতছাড়া হতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কৃষির মত খাতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ রাখার সুযোগ থাকে না। মোটকথা এটা হল একটা আলটিমেট কেউয়াস সিচুয়েশন।
★নিবন্ধটির লেখক বাংলাদেশের তরুণ অর্থনীতি গবেষক ওয়াসি মাহিন।